সিজোফ্রেনিয়া
সিজোফ্রেনিয়া

সিজোফ্রেনিয়া (ইংরেজি: Schizophrenia) একটি মানসিক ব্যাধি; এ রোগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে চিন্তাধারা এবং অনুভূতির প্রকাশের মধ্যে সঙ্গতি থাকে না৷এর লক্ষণগুলো হলো উদ্ভট চিন্তা, বিভ্রান্তিকর বা অলীক কিছু দেখা, অসঙ্গতিপূর্ণ কথাবার্তা এবং অন্যরা যা শুনতে পায় না এমন কিছু শোনা। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিক বা কর্মক্ষেত্রে সচারচর অক্ষমতাজনিত অসুবিধার সম্মুখীন হন৷ সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলি সাধারণত বয়ঃপ্রাপ্তির সময় দেখা দেয় এবং দীর্ঘ দিন স্থায়ী হয়৷
বংশগতি, শৈশবের পরিবেশ, নিউরোবায়োলজি এবং মানসিক ও সামাজিক প্রক্রিয়াসমূহ এ রোগের গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসাবে প্রতিভাত হয়৷ কিছু উত্তেজক মাদক এবং ওষুধ এ রোগের উপসর্গগুলোর আবির্ভাব বা এদের আরও গভীর করে বলে প্রতিয়মান হয়৷ বর্তমানে এ রোগের গবেষণায় নিউরোবায়োলজির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে, যদিও এখনো কোন একক জৈব কারণ শনাক্ত করা যায়নি৷ 
সারাবিশ্বের ০.৩–০.৭% মানুষ এ রোগে আক্রান্ত৷ ২০১৩ সালে আনুমানিক ২৩.৬ মিলিয়ন চিকিৎসাপ্রার্থী ছিল। আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ পর্যবেক্ষণ ও অতীত কর্মকান্ড পর্যালোচনার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করা হয়৷ এক্ষেত্রে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা, যেমন - দীর্ঘ সময় ধরে বেকারত্ব, দারিদ্র, আবাসনহীনতাকে প্রধান কারণ বলে গণ্য করা হয়।

সাধারনত কয়েক ধরনের সিজোফ্রেনিয়া দেখা যায়। যেমন-

  • প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া (Paranoid Schizophrenia): এর কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে, নিজেকে বিভিন্ন কারণে নির্যাতিত ভাবে এবং আশেপাশের মানুষের ব্যাপারে অহেতুক সন্দেহ প্রকাশ করে। কেউ তার ক্ষতি করতে চাচ্ছে বা তার ব্যাপারে সমালোচনা করছে- সবসময় এ রকম মনে করে থাকে।
  • ডিসঅর্গানাইজড সিজোফ্রেনিয়া (Disorganized Schizophrenia): এর কারণে কথাবার্তা ও চিন্তাধারায় অসংলগ্নতা দেখা দেয়। তবে ডিসঅর্গানাইজড সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তি বিভ্রমের শিকার হয় না।
  • ক্যাটাটোনিক সিজোফ্রেনিয়া (Catatonic Schizophrenia):  ক্যাটাটোনিক সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির আবেগ বা আচরণগত পরিবর্তন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে তার কথা বলা ও অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপ আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি সে কোনো কিছুর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতেও সক্ষম হয় না।
  • রেসিডিউয়াল সিজোফ্রেনিয়া (Residual Schizophrenia): এর কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি বেঁচে থাকার সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং হতাশ হয়ে পড়ে।
  • সিজোএফেক্টিভ ডিসঅর্ডার (Schizoaffective Disorder): এর কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার সাথে বিষন্নতার মতো অন্যান্য মুড ডিসঅর্ডারের লক্ষণ দেখা দেয়।

লক্ষণ

চিন্তাভাবনা ও আচরণের বিভিন্ন দিকের পরিবর্তন সিজোফ্রেনিয়ার সাধারণ লক্ষণ। এগুলোর মধ্যে পড়ে :

  • হ্যালুসিনেশন: হ্যালুসিনেশন হল একজন মানুষ যখন বাস্তবে নেই এমন কিছু বস্তু বা ব্যক্তির উপস্থিতি অনুভবের অভিজ্ঞতা লাভ করে।
  • বিভ্রম: বিভ্রম বা ডিলিউশন হল একটি বিশ্বাস যা প্রত্যয়ের সঙ্গে সম্পন্ন হয়, অথচ এটি ভুল, আশ্চর্য ও অবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির উপর প্রতিষ্ঠিত।
  • বিভ্রান্ত চিন্তা (বিশৃঙ্খল চিন্তা): বিশৃঙ্খল চিন্তার ফলে চিন্তাভাবনা ও কথোপকথনের মধ্যে সঙ্গতি থাকে না।
  • আচরণ ও চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন: এর ফলে আচরণ অসঙ্গত এবং অনির্দেশ্য হয়ে পড়ে যা অন্যদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়।

কারণ

এই রোগের সঠিক কারণ জানা যায়নি। তবে, যে যে কারণগুলিকে এই রোগের জন্য দায়ী করা হয়, সেগুলি হল-

  • জেনেটিক বা বংশগত এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও দেখা যায়। বাবা, মা-এর মধ্যে কারুর এই রোগ থাকলে সন্তানেরও হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
  • ভাইরাস সংক্রমণ, মানসিকভাবে অত্যন্ত চাপগ্রস্থ পরিস্থিতি, ইত্যাদির কারণে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • মস্তিষ্কে রাসায়নিক উপাদানের ত্রুটি এবং নিউরোকেমিক্যাল উপাদানে কোনও ঘাটতি হলে এই রোগ হয়।
  • গর্ভাবস্থায় এবং জন্মকালীন কোনও জটিলতা থাকলেও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
  • কিছু উত্তেজক মাদকদ্রব্য এবং ওষুধ এই রোগের কারণ।

ঝুঁকির বিষয়

বংশগত : বংশগত কারণে সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে, তবে কোনো নির্দিষ্ট জিন এর জন্য দায়ী নয়।

নিউরোট্রান্সমিটার : মস্তিস্কের কোষগুলোর মধ্যে বার্তা বহন করে নিউরোট্রান্সমিটার। নিউরোট্রান্সমিটার ও সিজোফ্রেনিয়ার মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে।

গর্ভাবস্থা ও জন্মের জটিলতা

  • গর্ভাবস্থায় রক্তপাত, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা প্রি-এক্লাম্পসিয়া
  • গর্ভের মধ্যে শিশুর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি, কম ওজনের শিশু
  • গর্ভাবস্থায় ভাইরাসের আক্রমণ
  • জন্মের সময় জটিলতা, অক্সিজেনের অভাব (এস্ফিক্সিয়া) ও সিজারিয়ান সেকশন

চাপ : চাপযুক্ত কোনো ঘটনা হল মানসিক বিভ্রান্তির ট্রিগার, যেমন মানসিক শোষণ, আপনার চাকরি বা বাড়ি হারানো, বিবাহবিচ্ছেদ বা সম্পর্কের ইতি, বা শারীরিক, যৌন, মানসিক বা জাতিগত শোষণ ।

ড্রাগের ব্যবহার : নির্দিষ্ট কতগুলো নেশার দ্রব্য যেমন গাঁজা, কোকেন, এলএসডি বা এমফেটামিন সিজোফ্রেনিয়া তৈরি করতে পারে ।

সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে যতোটা সমস্যা তৈরি করে, তার পরিবার ও আশেপাশের মানুষের জন্যও ঠিক ততোটাই জটিলতার সৃষ্টি করে। এটি একটি জটিল ব্যাধি হলেও সঠিক চিকিৎসা, পরিবারের সাহায্য ও আন্তরিকতার সাহায্যে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।


 

Moner Jotno