শিশু কিশোরদের মানসিক সমস্যা
শিশু কিশোরদের মানসিক সমস্যা

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশু-কিশোরদের মধ্যে দিন দিন মানসিক  নানাবিধ সমস্যার প্রকোপ বেড়ে চলেছে। বিশ্বায়নের প্রভাব এবং মূল্যবোধ ও আর্থসামাজিক সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে শিশুর মধ্যে মানসিক রোগের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারাবিশ্বে প্রায় ৪৫ কোটি মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে বাংলাদেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা প্রায় ২ কোটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দ্বারা পরিচালিত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে উঠে এসছে যে  বাংলাদেশের ১৩ দশমিক ৬ ভাগ শিশু কোন না কোন মানসিক রোগে ভুগছে। মেয়েশিশুর তুলনায় ছেলেশিশুদের মধ্যে মানসিক রোগের প্রকোপ বেশি। আমাদের দেশের শিশুদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের মানসিক রোগের সন্ধান পাওয়া যায় যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শিশুর বিকাশ ও আচরণগত সমস্যা, আটিজম, অতিচঞ্চলতা ও অমনোযোগীতা, ভয়, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতা, ঘুমের সমস্যা, বিছানায় প্রস্রাব করা, সিজোফ্রেনিয়া,  অবাধ্যতা, আক্রমণত্মক প্রবণতা, আত্মহত্যার চেষ্টা, স্কুলভীতি, খাদ্যভীতি, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা ইত্যাদি। মা-বাবার বয়সের বেশি পার্থক্য, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, একক পারিবারে বসবাস এবং পরিবারে কারও মানসিক রোগ থাকলে শিশুর মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবারিক ইতিহাস, জন্মের সময় মাথায় আঘাত পাওয়া, গর্ভাবস্থায় মায়ের পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব বা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং মা-বাবার মানসিক সমস্যা থাকলে শিশুর মানসিক রোগ, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা সহ বিভিন্ন ধরণের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।

কিছু মানসিক রোগ থাকলে শিশুর মধ্যে অবাধ্যতা দেখা যায়। যেমন: বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশুরা তাদের বোঝার অক্ষমতার জন্য অবাধ্যতা বেশি করে। অটিজম রয়েছে এমন শিশুরা নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। তাদের গুরুতর যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন সমস্যা থাকে। তারা বড়দের নির্দেশনা বুঝতে পারে না, ফলে তারা তা মানতেও পারে না। অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারএক্টিভিটি ডিজঅর্ডার আছে এমন শিশুরা মনোযোগের সমস্যার কারণে আচরণ সমস্যা বেশি করে। এছাড়া সাইকোসিস রোগ, সিজোফ্রেনিয়া বা এধরণের অসুখ হলে অসুখের বৈশিষ্ট্যের কারণেই তারা বেশ অবাধ্য আচরণ করে। শিশুদের মধ্যে বিষণ্নতা ও উৎকন্ঠা রোগ থাকলেও তাদের আচরণ খারাপ হয়ে থাকে।

দেশজুড়ে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ক্রমবর্ধমান বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শিশু কিশোরদের সুস্থ বিকাশ একটা সামাজিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক সমাজ জীবনের টেনশন ও বিভিন্ন সংঘর্ষের দরুন ছেলেমেয়েদের ব্যবহারেও নানাধরণের পরিবর্তন ও সংকট দেখা দিচ্ছে। বর্তমান সমাজে ছেলেমেয়েরা মূলত দুটি সংকটের মধ্যে বসবাস করছে। হয় তারা ভীষণ অবহেলার শিকার নয়তো মাত্রাতিরিক্ত যত্নের আদিখ্যেতার শিকার। স্কুলের পড়াশোনায় প্রচুর চাপের কারণে খেলাধূলা ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে শিশুদের আচরণগত সমস্যার একটি মস্তবড় উৎস হচ্ছে সমাজের ক্রমবর্ধমান দাবি দাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার প্রতিযোগিতা। পাশাপাশি রয়েছে জিনগত সমস্যা, জন্মগতভাবে প্রাপ্ত নানাধরণের বৈকল্য। তবে শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপের ফলেও বেশ কিছু রোগ দেখা দেয়।

শিশু কিশোরদের যে কোন ধরণের মানসিক সমস্যা যদি দ্রুত শনাক্ত করা না হয়, তবে ধীরে ধীরে তাদের আইনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ার আশংঙ্কা থাকে। তাই শিশু-কিশোরদের মানসিক সমস্যা সমাধানে অভিভাবকেরাই সবচেয়ে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রাখতে পারেন। দাম্পত্যকলহ সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ব্রোকেন ফ্যামিলির শিশু-কিশোররা মানসিক সমস্যায় বেশি ভুগতে থাকে। তাই সন্তানদের কথা বিবেচনা করে অভিভাবকদের কর্তব্য সন্তানদের জন্য অনুকূল পরিবেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শিশুরাই যেহেতু আগামী পৃথিবীর কর্ণধার। তাই তাদেরকে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয় যেকোনো জাতির মেরুদণ্ড। আর এ কারণে যাতে প্রতিটি শিশুই পরিপূর্ণ বিকাশের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠতে পারে, প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই সে বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।

Moner Jotno