শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো আবেগ। আবেগ মানুষের সহজাত একটি প্রবৃত্তি। জীবনে সফলতার জন্য আবেগের বিকাশ, সুষ্ঠু প্রকাশ এবং নিয়ন্ত্রন অতীব জরুরি। এই আবেগকে সাধারণত মোটা দাগে দুইটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হল ইতিবাচক আবেগ যার মধ্যে অন্যতম অন্তর্ভুক্ত আদর, ভালোবাসা, মায়া, মমতা, সুখ, আনন্দ ইত্যাদি এবং দ্বিতীয়টি নেতিবাচক আবেগ যার মধ্যে অন্যতম হল রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, কষ্ট, দুঃখ ইত্যাদি। এই আবেগগুলো স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে, কেননা যেকোনো মানুষ তার চিন্তার বহিঃপ্রকাশ করে আবেগের মাধ্যমে।
মানুষ হিসেবে জীবনে সফলতা অর্জনের জন্য আবেগের সুষ্ঠু বিকাশ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। একটা শিশুর জন্মের পর থেকেই শুরু হয়ে যায় তার আবেগের বিকাশ। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রথম দিকে শিশু অস্বস্তি প্রকাশ করে কান্নার মাধ্যমে। শিশু কোন কিছুতে ব্যথা পেলে বা কষ্ট পেলে বা অস্বস্তি বোধ করলে কান্না করে উঠে। পরবর্তীতে শিশু ধীরে ধীরে আরও অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের আবেগ শিখতে থাকে। আবেগের এই বিকাশে শিশুর মা-বাবা, পরিবার ও সমাজের অনেক অবদান থাকে তবে এক্ষেত্রে মা-বাবার অবদানটাই সবচাইতে বেশি।
যে সকল শিশু সঠিকভাবে আবেগ প্রকাশ করতে পারে তারা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুন্দর ভাবে খাপ খাওয়াতে পারে। তাদের স্কুলের ফলাফল ভালো হয়, বাবা-মা, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী সবার সঙ্গে তারা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারে। আবার যে সকল শিশুর আবেগীয় বিকাশটা সঠিকভাবে হয় না তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা তৈরি হতে পারে যার মধ্যে অন্যতম হল অতিরিক্ত রাগ করা, জিদ করা, কান্নাকাটি করা, পড়ালেখায় অমনোযোগী হওয়া, ঘুমের সমস্যা, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কম হওয়া, অতিচঞ্চলতা, অহেতুক ভয় পাওয়া, নেশায় আসক্ত হওয়া ইত্যাদি।
যেহেতু শিশুর আবেগের বিকাশে বাবা-মা প্রধান প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তাই আসুন জেনে নেওয়া যাক আবেগের সুষ্ঠু বিকাশে বাবা মা কিভাবে তার সন্তানকে সাহায্য করতে পারে।
- শিশুর কথাকে মনোযোগ দিয়ে শুনুনঃ শিশুর প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন কারন আপনি মনোযোগ দিয়ে না শুনলে শিশু তার আবেগ অস্বাভাবিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না।
- শিশুকে প্রশংসা করুনঃ শিশু যদি সঠিকভাবে তার আবেগ প্রকাশ করতে পারে তবে তার প্রশংসা করুন।
- নিজে সঠিকভাবে আবেগ প্রকাশ করুনঃ শিশুরা অনুকরণপ্রিয় হয়ে থাকে। আপনি যদি সঠিকভাবে আপনার আবেগ শিশুর সামনে প্রকাশ করতে পারেন তবে শিশুরাও সেটা অনুকরণ করতে শিখবে। আপনার ভালো আচরণ শিশুকেও ভালো আচরণ করতে উৎসাহিত করবে।
- শিশুর মেজাজ অনুযায়ী আচরণ করুনঃঃ সব শিশু এক রকম হয় না। জন্ম থেকেই শিশুদের মেজাজ আলাদা হয়। আবার শিশুর মনের ভাব সবসময় একইরকম থাকে না। তাই শিশুর মেজাজ অনুযায়ী পিতামাতাকে আচরণ করতে হয়।
- আদর-স্নেহ নিতে ও দিতে শেখানঃ একটি শিশুর মধ্যে জন্মগতভাবেই আদর-স্নেহের চাহিদা রয়েছে। মা-বাবার আদর-স্নেহ দানের মাধ্যমেই শিশু ভালোবাসা দিতে ও নিতে শেখে। তাই শিশুর মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টির জন্য তাকে যথেষ্ট আদর-স্নেহ দিন। শরীরে হাত বুলিয়ে তা প্রকাশ করুন। শিশু যদি আপনাকে জড়িয়ে ধরে আপনিও তাকে জড়িয়ে ধরুন।
- নিরাপদ আবেগীয় বন্ধন গড়ে তুলুনঃ শিশুর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও বুদ্ধিগত বিকাশের সাথে সাথে শিশুর আবেগীয় বিকাশ ঘটতে থাকে। শিশুর আবেগীয় বিকাশে আবেগীয় বন্ধন (অ্যাটাচমেন্ট) একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আবেগীয় বন্ধন বা অ্যাটাচমেন্ট হলো শিশুর সঙ্গে বাবা-মা বা অন্য কোনো লালন-পালনকারীর সঙ্গে একটি স্নেহের দৃঢ়বন্ধন। সুষ্ঠু আবেগীয় বন্ধন শিশুর মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ও আস্থা তৈরি করে। আর আস্থা ও নিরাপত্তাবোধের ওপর ভিত্তি করে শিশু তাঁর চারপাশের পরিবেশে পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান করতে শিখে। এভাবে ধীরে ধীরে শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস, আস্থাবোধ ও আবেগের একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়।
- শিশুকে আত্মবিশ্বাসী হতে শেখানঃ শিশুর আবেগের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য শিশুকে আত্মবিশ্বাসী হতে শিখতে হয়। শুধু তা-ই নয়, শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য তার নিজের সম্পর্কে ইতিবাচক অনুভূতি থাকা প্রয়োজন। এই ইতিবাচক অনুভুতিগুলোই তাকে নতুন কিছু করতে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। এই আত্মবিশ্বাসের ফলে শিশু নতুন নতুন জিনিস শিখতে আগ্রহী হয়ে উঠে যা পরবর্তীতে তাকে আত্মনির্ভরশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। শিশুর সঙ্গে তার সম্পর্কে ইতিবাচক এবং উৎসাহব্যাঞ্জক কথা বলুন যেন সে অনুধাবন করতে পারে যে সে ভালোবাসা পাওয়ার এবং বিভিন্ন কাজ করতে পারার যোগ্যতা রাখে।
- আবেগ প্রকাশে বাধা দেবেন নাঃ শিশুকে আবেগ প্রকাশে বাধা দিলে বা আবেগ প্রকাশের কারণে তাকে লজ্জা দিলে তার আবেগের সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। যেমন- শিশুকে যদি বলা হয় ‘ছেলেদের কান্না করতে নেই’, বা ‘এত ভয় পাওয়ার কি আছে?’ বা এত মন খারাপের কী আছে?’ তাহলে সে মনে করতে পারে তাঁর ভিতরে যে আবেগ কাজ করছে তা ঠিক নয়। সে হয়তো সারা জীবন তাঁর আবেগকে চেপে রাখবে ও নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়বে। বরং শিশুকে তার আবেগ প্রকাশে বাঁধা না দিয়ে তার আবেগকে স্বীকার করে তাকে আশ্বস্ত করুন এবং সে তার আবেগকে সঠিকভেবে প্রকাশ করতে পারলে তাকে প্রশংশা করুন।
এখানে মনে রাখা জরুরি, শৈশবের শিক্ষাটাই মানুষের পরবর্তী জীবনের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করে। আর শিশুরা বড়োদের অজান্তেই তাদের পর্যবেক্ষণ ও অনুকরণ করে শিখে। কাজেই সবচেয়ে আগে জরুরি শিশুকে আমরা যা শেখাতে চাই পিতা-মাতা এবং অভিভাবক হিসেবে নিজেরা সেইমতো আচরণ করা।