ব্যথা কি?
ব্যথা হল একটি অপ্রীতিকর সংবেদনশীল ও আবেগীয় প্রতিক্রিয়া যা কিনা মাংসপেশির অথবা কলাতন্ত্রের প্রকৃত অথবা সম্ভাব্য ক্ষতির কারণে অনুভুত হয়। এখান থেকে এটি স্পষ্ট যে ব্যথা শুধুমাত্র একটি শারীরিক সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া নয়, ব্যথার সাথে আমাদের আবেগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কিভাবে আমরা ব্যথা অনুভব করি?
আপনার হাতে একটি চিমটি কাটুন। আপনি কি ব্যথা অনুভব করছেন? হ্যাঁ করছেন। চলুন ব্যথার এই প্রক্রিয়াকে ভেঙ্গে দেখা যাক। একটা তত্ত্বের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়াটিকে ব্যাখ্যা করা যায়। এই তত্ত্বটির নাম হল গেট কন্ট্রোল থিওরি অফ পেইন। এই থিওরির মতে আমাদের মেরুদণ্ডে ব্যথা প্রবাহিত হওয়ার এক ধরণের গেট আছে। শরীরের কোন স্থানে আঘাত পেলে অথবা কোথাও কোন ক্ষত হলে ব্যথার সংকেত মেরুদণ্ডের ঐ গেট হয়ে আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং আমরা ব্যথা উপলব্ধি করি। বিভিন্ন পদ্ধতি এই গেটকে খুলতে ও বন্ধ করতে পারে।
পাশের ছবিটির এই গেটটিকে দেখুন। এই গেটটি খোলা থাকলে আপনি পেছনের বাগানে ঢুকতে পারবেন, আর বন্ধ থাকলে পারবেন না।
আমাদের ব্যথার গেটও একই ভাবে কাজ করে। আমাদের মস্তিষ্ক সংকেত প্রেরণ করে আমাদের মেরুদণ্ডে অবস্থিত ব্যথার এই গেটকে বন্ধ করতে ও খুলতে পারে। ব্যথার এই গেটটি বন্ধ থাকলে আমরা ব্যথা অনুভব করি না, কম খোলা থাকলে আমরা কম ব্যথা অনুভব করি, এবং পুরোপুরি খোলা থাকলে অনেক তীব্র ব্যথা অনুভব করি।
অনেক বিষয় বা পদ্ধতি আমাদের ব্যথার এই গেটকে বন্ধ করতে বা কম খোলা রাখতে সাহায্য করে। গেটটি বন্ধ থাকলে আমরা ব্যথা অনুভব করি না এবং কম খোলা থাকলে আমরা কম ব্যথা অনুভব করি।
ইতিবাচক চিন্তা, চিন্তন আচরণ চিকিৎসা, চিত্তবিক্ষেপ (ব্যথা থেকে মনোযোগ অন্য দিকে সরানো), নিঃশ্বাসের মাধ্যমে গভীর শিথিলায়ন, আনন্দপূর্ণ কাজকর্মের সাথে যুক্ত থাকা ব্যথার গেটকে বন্ধ রাখতে বা আংশিক খোলা রাখতে সাহায্য করে, যাতে করে আমরা কম ব্যথাবেদনায় ভুগি। ব্যথার বিভিন্ন ঔষধ ও ব্যথার গেটকে বন্ধ রাখতে কাজ করে থাকে।
বিপরীতভাবে, মস্তিষ্ক ব্যথার এই গেটে সংকেত পাঠাতে পারে গেটটিকে খোলা রাখার জন্য। শক্তিশালী নেতিবাচক আবেগ যেমন ভয়, উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা, সবথেকে খারাপটি ভাবা ব্যথার এই গেটটিকে খোলা রেখে ব্যথাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ব্যথা সম্পর্কিত কিছু বিষয়ঃ ব্যথা আপনার জীবনের সকল ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলতে পারে। যদি আপনার ব্যথা থাকে তাহলে দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্মে আপনি অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। ঘুমানো এবং খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও হয়তো সমস্যা হতে পারে। আপনার ভালোবাসার মানুষদের প্রতি আপনি বিরক্ত হয়ে যেতে পারেন। ব্যথার কারণে খুব সহজেই আপনি হতাশ, বিমর্ষ বা রেগে যেতে পারেন। পরিবারের লোকজন বা বন্ধুবান্ধব সবসময় বোঝে না আপনি কেমন অনুভব করছেন, একারনে আপনি খুবই একাকীত্ব অনুভব করতে পারেন।
সকল ব্যথারই চিকিৎসা আছে এবং বেশিরভাগ ব্যথারই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব অথবা ব্যথা থেকে নিরাময় পাওয়া সম্ভব। যখন ব্যথা নিয়ন্ত্রনে থাকে তখন মানুষ ভালোভাবে ঘুমাতে ও খাদ্য গ্রহণ করতে পারে, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ উপভগ করতে পারে, দৈনন্দিন জীবনের কাজের সাথে শখের কাজগুলো করতে পারে।
ব্যথা ব্যাবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তাঃ অপর্যাপ্ত ব্যথা ব্যাবস্থাপনা ব্যক্তি ও তার পরিবারের মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উপর প্রভাব ফেলতে পারে (ওয়েলস এবং সহযোগীবৃন্দ, ২০০৮)। অনিয়ন্ত্রিত ব্যথার কারণে ব্যক্তির চলাফেরার পরিমাণ কমে যায়, যে কারণে সর্বোপরি ব্যক্তির গুনগুত জীবনযাত্রার মান হ্রাস পায়। চলমান অনিয়ন্ত্রিত ব্যথা ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও প্রভাব ফেলে। ব্যথার সাধারণ কিছু মানসিক প্রতিক্রিয়া হল উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতা। তাছাড়া ব্যথার কারণে ব্যক্তির ক্ষুধা, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, ও আন্ত-ব্যক্তিক সম্পর্কের উপর ও প্রভাব পড়ে (প্যাডিলা এবং সহযোগীবৃন্দ, ১৯৯০)। অনিয়ন্ত্রিত ব্যথা যেহেতু শুধুমাত্র ব্যক্তির উপর নয়, ব্যক্তির পরিবারের উপরও প্রভাব ফেলে সেকারণে ব্যথার ব্যাবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত কয়েক দশকের গবেষণা নির্দেশ করে যে ব্যথা ব্যাবস্থাপনার ক্ষেত্রে ঔষধিক ও অ-ঔষধিক (যেমন, জ্ঞানীয় আচরণ চিকিৎসা) ব্যাবস্থাপনার সমন্বিত চিকিৎসাই ভালো ফলাফল দেয় (বনিকা, ১৯৯০; থমাস এবং উইস, ২০০০; গ্যাচেল এবং টার্ক, ১৯৯৯)।
ব্যথার চিকিৎসায় জ্ঞানীয় আচরণ চিকিৎসার ভূমিকাঃ যদি আপনি বিষণ্ণ বা উদ্বিগ্ন থাকেন তাহলে আপনার ব্যথার অবস্থা অধিকতর খারাপ মনে হতে পারে। ব্যথার কারণে আপনি দুশ্চিন্তিত, বিমর্ষ অনুভব করতে পারেন অথবা খুব সহজেই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়তে পারেন। কিছু কিছু মানুষ অসহায় বা আশাহীনতায় ভুগতে পারে। অন্যান্যরা হয়তো অপ্রস্তুত, অযোগ্য, ক্রোধ, শঙ্কিত, একাকীত্ব, অথবা ক্ষিপ্ত অনুভব করতে পারেন। এ সবগুলোই সাধারণ অনুভুতি।
দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার কারণে ব্যক্তির মধ্যে নেতিবাচক চিন্তা, আবেগ ও আচরণের উদয় হতে পারে যা কিনা পরবর্তীতে ব্যথার অবস্থা আরও দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। জ্ঞানীয় আচারনগত চিকিৎসার লক্ষ্য হল ঐ সকল নেতিবাচক চিন্তা ও আচরণকে চিহ্নিত করা যাতে করে ব্যক্তি আরও ইতিবাচক ও বিকল্প পদ্ধতিতে ব্যথার সাথে খাপ খাওয়ানোর কৌশল শিখতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার জন্য জ্ঞানীয় আচারনগত চিকিৎসা ব্যক্তিকে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার সাথে সংগ্রাম করার জন্য ক্ষমতাশীল করে যাতে করে ব্যক্তি সক্রিয়ভাবে তার কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা তার জীবনে যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
যাদের সাথে কথা বলাটা আপনি আরামদায়ক মনে করেন তাদের সাথে আপনি আপনার এ অনুভুতিগুলো সম্পর্কে জানাতে পারেন। পাশাপাশি আপনি আপনার ডাক্তার, নার্স, সমাজকর্মী, পরিবারের লোকজন ও বন্ধুবান্ধবের কাছে আপনার অনুভুতিগুলো জানাতে পারেন। চাইলে আপনি পেশাদার মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী (চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী) অথবা কাউন্সিলরের সাথে কথা বলতে পারেন যারা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে কাজ করার উপর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
চাইলে আপনি সহায়তাকারী কোন দলের কথা বিবেচনা করতে পারেন যেখানে বিভিন্ন ধরণের ব্যথায় আক্রান্ত রোগীরা একে অপরের সাথে নিজেদের অনুভুতিগুলো ভাগাভাগি করে।
মনে রাখবেন
- দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা আপনার জীবনের প্রত্যেকটি অংশে প্রভাব ফেলতে পারে
- দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার জন্য জ্ঞানীয় আচারনগত চিকিৎসা আপনাকে পূর্বের জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে।